সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে প্রথম ধাপের পরীক্ষায় ব্যাপক জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। প্রক্সি, প্রশ্নফাঁস ও জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় দেড়শ জনকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়াও বহিষ্কার হন ৭০ জন। গ্রেফতারদের অনেকে চাকরিপ্রার্থী। আবার কেউ জালিয়াতিতে সহযোগিতা করে গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের নামে মামলাও করেছে প্রশাসন।
অথচ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার লালমনিরহাটের এক চাকরিপ্রার্থী ‘অলৌকিকভাবে’ পাসও (মৌখিক পরীক্ষা জন্য নির্বাচিত) করে গেছেন। গত ২০ ডিসেম্বর রাতে প্রকাশিত লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে নির্বাচিতদের তালিকায় রয়েছে ওই প্রার্থীর রোল নম্বর। অথচ ৮ ডিসেম্বর পরীক্ষার দিন সকালে ওই রোল নম্বরধারী গ্রেফতার হন।
গ্রেফতার হওয়ার পরও ফলাফলে পাস করা ওই চাকরিপ্রার্থীর প্রবেশপত্র, ব্যবহৃত ডিভাইস, গ্রেফতারের দিনের ভিডিও গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। এছাড়া পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া খবর, ছবি ও ভিডিও যাচাই করে মিলেছে সত্যতা।
পরীক্ষার দিন রফিকুল ইসলাম ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার হন। গ্রেফতার ১৯ জনকে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানের কার্যালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে হাজির করা হয়। সেখানে তাদের প্রবেশপত্র, ব্যবহৃত ডিভাইস, মোবাইল ফোনসহ জালিয়াতির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিও দেখানো হয়।
‘সৌভাগ্যবান’ ওই প্রার্থী মো. রফিকুল ইসলাম, রোল নম্বর ৪১২৩৫৯১। ওএমআর শিটে তার সেট কোড ছিল ‘যমুনা’। তিনি লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার প্রার্থী। বাবার নাম মো. শামসুল হুদা। তার পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল লালমনিরহাট সদর উপজেলার নেছারিয়া কামিল মাদরাসা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরীক্ষার দিন রফিকুল ইসলাম ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার হন। গ্রেফতার ১৯ জনকে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরপিএমপি) কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানের কার্যালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে হাজির করা হয়। সেখানে তাদের প্রবেশপত্র, ব্যবহৃত ডিভাইস, মোবাইল ফোনসহ জালিয়াতির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিও সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন মো. মনিরুজ্জামান।
ওইদিন ব্রিফিংয়ে আরপিএমপি কমিশনার জানান, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় বিটু এক্স ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশ্নপত্রের উত্তর বাইরে থেকে দেওয়ার চুক্তি করেছে একটি চক্র। এ তথ্য পাওয়ার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে জালিয়াতির চেষ্টা করা চাকরিপ্রার্থী ও সহযোগীদের গ্রেফতার করেছে।
কারা গ্রেফতার বা বহিষ্কার হয়েছিলেন, সেসব রোল আমাদের মুখস্ত নেই। ১৭ জন বহিষ্কার হয়েছিলেন, এটাই মনে আছে। আর ফল প্রকাশ হলেও আনুষ্ঠানিক ফলাফলের শিট আমাদের হাতে আসেনি। আসার পর রোল নম্বর মিলিয়ে দেখতে পারবো ওই রোলধারী বহিষ্কার কিংবা গ্রেফতার হয়েছিলেন কি না।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে লালমনিরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায় চৌধুরী বলেন, ‘কারা গ্রেফতার বা বহিষ্কার হয়েছিলেন, সেসব রোল আমাদের মুখস্ত নেই। ১৭ জন বহিষ্কার হয়েছিলেন, এটাই মনে আছে। আর ফল প্রকাশ হলেও আনুষ্ঠানিক ফলাফলের শিট আমাদের হাতে আসেনি। হয়তো আগামীকাল (শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর) পাবো। তখন রোল নম্বর মিলিয়ে দেখতে পারবো ওই রোলধারী বহিষ্কার কিংবা গ্রেফতার হয়েছিলেন কি না।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও তো ফলাফলের কপি প্রকাশ করা হয়েছে। সেটা তো আপনার অধীনে হয়ে থাকে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এতকিছু জানি না। এসব নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই।’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট প্রকৌশলী অনুজ কুমার রায় বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই। অধিদপ্তরের পলিসি অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের পরিচালক জানেন।’
অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে এ নিয়ে জানতে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শাহ রেজওয়ান হায়াতও কল রিসিভ করেননি।
অধিদপ্তরের গবেষণা কর্মকর্তা (নিয়োগ) এস এম মাহবুব আলম বলেন, ‘আমাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। কেউ জানালে বা অভিযোগ করলে আমরা ভেবে দেখবো।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কিছু জানা নেই। নিয়োগ কমিটি এগুলো নিয়ে ভালো বলতে পারবে।’
প্রার্থী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরিচিতদের কাছ থেকে পাওয়া তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ রয়েছে। তাকে চেনেন- এমন দুজন চাকরিপ্রার্থী জানান, তারা যতদূর জানেন, গ্রেফতারের পর রফিকুলের এখনো জামিন মেলেনি।
গত ৮ ডিসেম্বর রংপুর, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের ১৮ জেলায় একযোগে প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা হয়। এ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে আবেদন করেন ৩ লাখ ৬০ হাজার ৬৯৭ জন চাকরিপ্রার্থী।
এদিকে, অনিয়ম-জালিয়াতি হয়েছে অভিযোগ তুলে পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন কিছু প্রার্থী। তারা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে লিখিত আবেদন ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি করেন। পাশাপাশি ৫৪ জন প্রার্থীর পক্ষে ফাতেমা আক্তার নামে একজন প্রার্থী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন। এ রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফল প্রকাশ ও নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে দুই মন্ত্রণালয়সহ ১৩ অধিদপ্তর-দপ্তরে নোটিশও পাঠান।
তবে নিয়োগ সংশ্লিষ্টরা এ নোটিশ পাননি বলে জানান। এরই মধ্যে গত ২০ ডিসেম্বর রাতে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে প্রথম ধাপের ফল প্রকাশ করা হয়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ৯ হাজার ৩৩৭ জন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তাদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার কথা রয়েছে।